শুক্রবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৫

১২ বৈশাখ ১৪৩২

leading admission leading admission
শুক্রবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
১২ বৈশাখ ১৪৩২
সরকারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর- ১৮২
আপনি পড়ছেন : মতামত

শিক্ষাপদ্ধতি: সব আমলেই গিনিপিগ শিক্ষার্থীরা


আলমগীর খান
2024-10-05
শিক্ষাপদ্ধতি: সব আমলেই গিনিপিগ শিক্ষার্থীরা

হাসিনা সরকারের আমলে যথেচ্ছাচারিতা চরম আকার ধারণ করেছিল, কারও মতামতের তোয়াক্কা না করেই তারা সবার মঙ্গল সাধনের মহান কর্মে নিযুক্ত হয়েছিল! এত যথেচ্ছ মঙ্গল যে মানুষের কাম্য নয়, সে বোধও তাদের ছিল না। এমনই এক বিরাট কর্মযজ্ঞ তারা শুরু করেছিল এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে। আমূল পরিবর্তনের যে কাজে তারা হাত দিয়েছিল, অনেকেই তাকে মনে করছিলেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটন। অবশেষে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সমূলে উৎপাটিত হলো তারা নিজেরাই। আমূল পরিবর্তন ও সমূল উৎপাটনের এই ধকল এখনও সইতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। অথচ এইসব তুঘলকি কাণ্ড থেকে শিক্ষাকে মুক্ত রাখা ছিল সবার নৈতিক দায়িত্ব। তবে এ কথা বলা আর চোরকে ধর্মের কাহিনি শোনানো তো একই!

আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন সরকারের হাতে গিনিপিগ। যার যখন যেভাবে মনে চায়, শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ নিয়ে তেমনই একেকজন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেমে পড়েন। বিগত সরকারের আমলে ওই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এক চরম আকার ধারণ করেছিল। ওই সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ছিল না বলে নিজেদের খেয়াল-খুশিকেই তারা শিক্ষার্থীদের মঙ্গল বলে চাপিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার নামে অনেকগুলো পরিবর্তন ছিল গুণগান গাওয়া শেখানো ও দলপ্রীতি তৈরির প্রকল্পমাত্র।

এখনও যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারাও সকলের মঙ্গল সাধনে কাছা দিয়ে নেমে পড়েছেন, তা কেউ চাক বা না চাক। শিক্ষার নতুন কাণ্ডারিরা তো আর আকাশ থেকে আসেননি, এই দেশ ও সমাজেরই। তাদেরও হাল ধরার ধরন পুরনোদের থেকে খুব আলাদা নয়। অনেকেই এমনসব কথাতবার্তা বলছেন যেন আওয়ামী যুগের আগের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বিশ্বের এক নম্বর। এটা বলা সবচেয়ে সহজ ও তাতে মাঠের জয় সুনিশ্চিত। তর্কের সহজ পাটিগণিতীয় ধরনটা হলো: যেহেতু আওয়ামী আমলের শিক্ষাক্রম খারাপ, আওয়ামী-পূর্ব আমলটি নিশ্চয়ই ‘গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ও গোয়াল ভরা গরু’র মত একেবারে হীরার টুকরা। জনমানুষের মনে আওয়ামী ও হাসিনা-বিদ্বেষের কারণে পুরনো বস্তাপচা মালকেও এখন খাঁটি সোনা বলে চালানোর চেষ্টা চলছে।

যারা এখন পুরনোর গুণগানে নেমে পড়েছেন তারা ওই শিক্ষক্রমের কোন রূপে মজেছেন তা কিন্তু কৌশলে গোপন করে যাচ্ছেন। অথচ আওয়ামী সরকারের নিরানব্বইটা মিথ্যার বাইরে একটা সত্য কথা ছিল যে, পুরনো শিক্ষাব্যবস্থা মোটেও আধুনিক, দেশজ ও গণমুখী ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের খুঁটিতে বাঁধা ওই শিক্ষাক্রম ও ব্যবস্থা। যা কেবলই কেরানি, বৈদ্য ও মিস্ত্রি তৈরির জন্য নির্মিত হয়েছিল, যাদের একমাত্র লক্ষ্য ব্যক্তিগত উন্নতি সাধন যেখানে নৈতিকতার বালাই নেই।

তবে আশার কথা হচ্ছে, এই নতুন আমলে শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ মূল কাণ্ডারিরা এ কথা বেমালুম ভুলে যাননি। স্পষ্টতই তারা নতুনটা ভাবনাচিন্তাহীনভাবে ফেলে দিয়ে পুরনো দুষ্ট ও ভঙ্গুর ব্যবস্থাটিকে প্রাণের মতো আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছেন না। আপাতত বর্তমানের জন্য দুইয়ের একটা সমন্বয়ের কথা বলছেন। কারণ হিসেবে বলছেন যে, নতুন শিক্ষক্রমের মূল সমস্যা তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, যা চলমান পরিস্থিতিতে প্রায় অসম্ভব। এ কথার মানে এই নয় যে, পুরনোটা আহামরি গোছের ভালো।

পুরনো শিক্ষাক্রম ও ব্যবস্থার পরিবর্তনটা ঐতিহাসিকভাবে জরুরি। কিন্তু এটি জামাকাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে বিদেশ থেকে ভালো দেখে একটা আমদানি করার বিষয় ছিল না। যা পতিত আওয়ামী সরকার করেছিল। যা প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে ব্যাপক গণআলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের ভিত্তিতে পাঠ্যবইয়ে, শিখন-শেখানোয় ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে একটা বিবেচনাপ্রসূত সতর্ক ধীর পরিবর্তন। ভুল হলেও যেখানে ফিরে এসে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ও নতুন পথ সন্ধানের সুযোগ থাকে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় সামান্য ভুলের বিরাট মাশুল গুণতে হয় শিক্ষার্থীকে, যাদের বেলায় সে ভুলের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।

এরকম ভুল কি শিক্ষার নতুন কারিগররাও করতে চলেছেন? শিক্ষাক্ষেত্রে হঠাৎ ব্যাপক রদবদল কখনও শুভবুদ্ধিপ্রসূত হয় না। নতুন পাঠক্রম ও পদ্ধতির ভালো দিকগুলো রক্ষা করেই কেবল পুরনো পদ্ধতিতে আংশিক ফিরে যাওয়া উচিত। পুরনো পদ্ধতির বিখ্যাত সংকটগুলো হচ্ছে মুখস্থবিদ্যা, নোটগাইড নির্ভরতা, প্রাইভেট ও কোচিংমুখিতা, ক্রিকেট বা ডাংগুলি খেলার মতো প্রতিযোগিতা, নম্বরপ্রিয়তা, ভালো রেজাল্টের প্রতি অমানসিক আকর্ষণ, ভালো ছাত্র নামধারী সবংর্ধনা, জ্ঞান ও আদর্শবিমুখতা, নৈতিকতাহীনতা, মিথ্যার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, শিক্ষাদানকে ব্যবসায়ে পরিণত করা, জ্ঞানকে বাজারি পণ্য করা ইত্যাদি। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার এই সংকটগুলো দূর করার কথা জোরেশোরে বলেছিল— মনের ভেতর অন্য কথা ছিল কিনা জানি না। কিন্তু এই সংকটগুলো বিদ্যমান রেখে পুরনো পাঠক্রমের গুণগান করা আগামী প্রজন্মকে ধোঁকা দেওয়ার সমতুল্য।

পুরনো শিক্ষাক্রমে কি ভালো কিছুই ছিল না? ছিল বৈকি! এর সবচেয়ে বেশি ভালো দিক ছিল একটি কায়েমি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারা! যেকোনো খারাপ ব্যবস্থারই প্রাণের বিনিময়ে কিছু রক্ষাকারী থাকে কারণ প্রত্যেক খারাপ ব্যবস্থাই কোনো না কোনো একটা সংকীর্ণ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে। যেকোনো নতুন ব্যবস্থাই ওই পুরনো কায়েমি গোষ্ঠীর জন্য অনিশ্চিত ও আতঙ্কের। পুরনো শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতির ফসল হচ্ছে দেশব্যাপী আজকের নামি-দামি স্কুল-কলেজ, ব্যয়বহুল প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একইসঙ্গে উজ্জ্বল প্রদীপের তলায় জমে আছে বিরাট অন্ধকার, যেখানে বাকি খারাপ স্কুল-কলেজগুলো কোনোমতে টিকে থাকে।

নতুন শিক্ষাক্রমের সহিংস সমালোচকেরা এই ভালোমন্দ সব মুছে যাওয়ার আতঙ্কে নিদ্রাহীন। মেধাবী ও মেধাহীনের পার্থক্য তাদের চাই-ই চাই। না হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদির অভাবে দেশ রসাতলে যাবে— এই ‘দেশপ্রেমিক’ ভয়! যে দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা ডাক্তারি (বা ইঞ্জিনিয়ারিং বা টাকা বানানোর ম্যাজিক মেশিনওয়ালা অন্যান্য বিষয়) নিয়ে পড়ালেখা করে ও উজ্জ্বল সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে পাশ করে, সে দেশের সচ্ছল সিংহভাগ মানুষ ভিনদেশে চিকিৎসা নিতে দৌড়ায় কোন আনন্দে?

নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতিতে নোটগাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য কমানোর চেষ্টা ছিল, প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের উদ্যোগ ছিল, ক্লাসের পাঠবইয়ের বাইরেও বাইরের জগতের বই ও চিন্তাসম্পদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযোগ ঘটানোর প্রয়াস ছিল, শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক-নৈতিক-মানবিক সমাজমনস্ক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল— এগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু লক্ষ্য পূরণের প্রক্রিয়াটা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। শিক্ষকদের যোগ্যতা ও নতুন মানুষ হিসেবে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার উচ্চ লক্ষ্যের মাঝে ব্যবধান ছিল বিরাট, স্বল্পসময়ে যা ঘোচানো সম্ভব নয়। কিন্তু লক্ষ্যসমূহ ন্যায্য ও জরুরি— নতুন কারিকুলাম পাল্টে পুরনোটা জড়িয়ে ধরার সময় এ লক্ষ্যসমূহও ছুঁড়ে ফেলা উচিত হবে না।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এত যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে সেখানে কাউকে তো দেখছি না কিছু মৌলিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। বাংলাদেশে মানুষের শিক্ষাটা যে মাতৃভাষায় হওয়া প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার, ইংরেজি বা বিদেশি ভাষা যে কেবল একটি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবেই থাকতে পারে, বাধ্যতামূলক নয়, কারও মুখে তো এসব কথা নেই। আমাদের কি একবারও মনে হয় না যে, স্বতন্ত্র উন্নত ভাষাসমৃদ্ধ একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের একটি ঔপনিবেশিক বিদেশি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন? মনে হওয়ার কথা নয়, কারণ তাদেরও স্বার্থের গাঁটছড়া তো সেই একই খুঁটির সঙ্গে বাঁধা যেখানে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে গেড়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষার খুঁটি।

বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক নৈতিকতাসমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ ও দেশ তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক, সর্বজনীন, সৃজনশীলতাকেন্দ্রিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার কারিগর নয়, শিল্পীতুল্য স্থপতি প্রয়োজন। তার অভাবে আসন্ন পরিবর্তন রঙচঙ বদলানোয়ই সীমাবদ্ধ হবে— যাদের একমাত্র কৃতিত্ব হবে পুরনো শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার বীরত্ব। আর ওই একই নোটগাইড-কোচিংমুখী নতুন পাঠ্যবই লেখা, পরিমার্জন, সংস্করণ, ছাপানো, বাতিল ও আবার ছাপানো ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ। সঙ্গে নিজেদের পাণ্ডিত্যমূলক বিশেষজ্ঞতা নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। তার ওপর গণমানুষকে বিতর্কের বাইরে রেখেই যদি এই মহাযজ্ঞের আয়োজন চলে তবে তো কথাই নেই!