রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫

২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

leading admission leading admission
রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
সরকারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর- ১৮২
আপনি পড়ছেন : সিলেট

ওসমানি হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগের চিত্র

জনবল ও শয্যার চেয়ে হৃদরোগীর সংখ্যা ৫ গুণ বেশি


তাইনুল আসলাম
2025-09-29
 জনবল ও শয্যার চেয়ে হৃদরোগীর সংখ্যা  ৫ গুণ বেশি

বিশ্ব হার্ট দিবস পর্ব -১ 

প্রতিবছর আশংকা জনক হারে বাড়ছে হৃদরোগীর সংখ্যা। ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ভর্তি হওয়া রোগী বৃদ্ধির হার বছর প্রতি গড় ২ হাজার জনের বেশি। ২০২২ সালে চিকিৎসা নেয়া  মোট রোগীর সংখ্যা যেখানে ১২ হাজার ৬০০ জন। গত বছরের আগস্ট  থেকে  চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ১২৬ জন রোগী।  হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের ২য় তলায় ১৬ নং ওয়ার্ড হৃদরোগ বিভাগ। ওয়ার্ডের ফটকের বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে আছেন অসংখ্য রোগী। মেঝেতে শুয়ে শতাধিক হৃদরোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।


হয়তো ভাবছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা? কিন্তু না, ওয়ার্ডে স্থান সংকুলানের কারণে রোগিদের ফিরিয়ে না দিয়ে মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখার পর অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু বাস্তব ঘটনা জানার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতাবোধ আরো বহুগুন বেড়ে যায়।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র ৩৪ শয্যার হৃদরোগ বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১ জন অধ্যাপকসহ মাত্র ২০ হৃদরোগের চিকিৎসক এবং ২০ জন নার্স নিয়োজিত রয়েছেন তাদের সেবায়। মোট জনবল ও শয্যার চেয়ে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি। এই জনবল নিয়ে রোগীদের প্রতিনিয়ত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।


শয্যার অভাবে হয়তো কাউকে কাউকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। জনবলের অভাব কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছেন না কর্তব্যরতরা। তারা সাধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দিতে না পারায় ডাক্তার ,নার্স ও সাপোর্ট স্টাফদের মনে রয়েছে বিশাল আক্ষেপ ক্ষোভ।


সরেজমিন দেখা যায়, দিনদিন রোগীর সংখ্যা বাড়লেও স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয় থেকে বাড়ানো হচ্ছে না সুযোগ সুবিধা। জনবল ও সুযোগ সুবিধার সংকট নিয়েই মানুষের হৃদয় (হার্ট) ভাল রাখার অন্ত:প্রাণ চেষ্টা চিকিৎসক, নার্স ও সাপোর্ট স্টাফদের।


নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা আনসার সদস্য নেই পর্যাপ্ত। যদিও নিয়মিত ৫জন সদস্য থাকার কথা থাকলেও বেশির সময় আনসার সদস্য চাহিদা মোতাবেক পাওয়া যায়না।

যার ফলে রোগীদের সেবা প্রদানে ঘটে মারাত্বক ব্যাঘাত। কেননা রোগীর চেয়ে স্বজনদের উপস্থিতি থাকে দ্বিগুন। এই অবস্থায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ডাক্তার ও নার্সদের। বেশির ভাগ সময় চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পরষ্পরের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।


এ বিষয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোখলেছুর রহমান বলেন, জনবল ও সুযোগ-সুবিধার তুলনায় রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ বা ৫ গুণ বেশি। তবুও মানসম্মত সেবা প্রদানে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন, সিলেটের মানুষ আরো বেশি মানসম্মত সেবা পাবে।

আমাদের হৃদরোগ বিভাগে মাত্র ৩৪টি শয্যা থাকলেও প্রতিদিন এর চেয়ে ৫ গুণ বেশি রোগীর ধকল সামলাতে হয়। রোগীর সাথে আসা স্বজনরা থাকেন একাধিক। সব মিলিয়ে ৩৪ জনের একটি ওয়ার্ডে ৩শ’র ওপর মানুষের অবস্থান।


তিনি বলেন, আমাদের নেই পর্যাপ্ত জনবল। হৃদরোগ বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে বেশিরভাগ রোগী গুরুতর (সিরিয়াস কন্ডিশন)। তবুও সামর্থ যা আছে, তার চেয়ে বেশি চেষ্টা রয়েছে। আমাদের কাছে যখন রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসে, আমরা কাউকে ফেরত দিতে পারিনা।

এখানে আসা বেশিরভাগ রোগীর অসহায় ও হতদরিদ্র অবস্থান থেকে আসে। কেননা, প্রাইভেট ক্লিনিকে খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ থাকে না। সেসব রোগিদের সবার ভরসার জায়গা ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এক কথায়, রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদানে আমাদের যতেষ্ট সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলেও সক্ষমতা নেই।


সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, সিলেট বিভাগে জনসংখ্যার পাশাপাশি ক্রমেই হৃদরোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে প্রতিদিন হৃদরোগীদের ভীড় নামে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অথচ সেই তুলনায় হৃদরোগ চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। প্রতিদিন হৃদরোগীর ঢল নামে, আউটডোর-ইনডোরে কিভাবে তাদের সামাল দেই।

আর সরকারী হাসপাতালে আসা রোগীরা অধিকাংশই হতদরিদ্র। ক্লিনিকে চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। অথচ মাত্র ৩৪ বেডের হৃদরোগ বিভাগ। জনবলসহ সার্বিক সুবিধাদিও বেডের অনুপাতেই। এই সামান্য সামর্থ্য দিয়েই ৫/৬ গুণ বেশি প্রায় দেড়শ রোগী নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হৃদরোগীদের ফ্লোরে শুইয়ে চিকিৎসা দেয়ার নিয়ম নেই। তারপরও বাস্তবতা বাধ্য করেছে।রোগীরা তাতেও সন্তুষ্ট।


অধ্যাপক ডা. মোখলেছুর রহমান আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে টেকনিশিয়ান নিয়ে। গত শনিবার সরজমিন দেখা গেল ডাক্তারসহ সব স্টাফরা থাকলেও একমাত্র টেকনিশিয়ান ছুটিতে থাকায় ক্যাথলাবের কোনো কাজই হয়নি!


হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা: মাহবুবুল আলম জানান, এত প্রতিকুলতার মাঝেও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে র‌্যাংকিংয়ে সারা বাংলাদেশে ২য় অবস্থানে রয়েছে ওসমানি হাসপাতাল। ৯০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও ৫০০ শয্যার জনবল রয়েছে। হৃদরোগ বিভাগে মোট ৩৪টি বেড, এরমধ্যে ৮ টি পেয়িং বেড। তবে কোন কেবিন নেই। অথচ শুধু বহির্বিভাগেই গত ১ বছরে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮৭৩ জন রোগীকে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ১০টি সিসিউ বেড চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংকটাপন্ন রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা সেবা দিতে সুবিধা হবে। এছাড়াও গত ২১ সেপ্টেম্বর নতুন করে আরেকটি ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ১ম ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হয়। এনিয়ে ২টি ক্যাথল্যাবে রোগীদের সেবা প্রদান করা যাবে।


হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আদিল জানান, হাসপাতালের অর্ন্তবিভাগে গত এক বছরে প্রায় ১৫,১২৬ জন হৃদরোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে ১০,৭২৫ জন পুরুষ এবং ৪৪০১ জন মহিলা ছিলেন। এছাড়াও ৫৭ জন শিশু সেবা গ্রহণ করেন। চিকিৎসা সেবা নিতে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৫.৫ শতাংশ । সেই হিসেবে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে বছরে প্রায় ৮৩২ জন রোগী মৃত্যু বরণ করেন।

কার্ডিওলজি বিভাগ জানায়, গত এক বছরে এনজিওগ্রাম সেবা গ্রহণ করেছেন মোট ৮৩১ জন। রিং (পিসিআই) লাগিয়েছেন ৮০ জন, টিপিএম করেছেন ১৪৩ জন, পিপিএম করেছেন ১০ জন, পেরিকার্ডিও সেন্টেসিস করেছেন ৭৩ জন। পেড্রিয়াটিক স্ক্রেনিং নির্ণয়ের জন্য প্রোগ্রাম করা হয়। যেখানে ১৮৭ জন শিশুকে এই সেবা দেয়া হয়। মুনতাধা ফাউন্ডেশনের এর উদ্যেগে ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেদওয়ানা রিমার নেতৃত্বে সিলেটে ১ম বারের মত ৮ শিশুর ডিভাইস লাগানো হয়।


হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওসমানীতে এনজিওগ্রাম ৬ হাজার টাকা, ইকো-কালার ৬০০ টাকা, ইসিজি-৮০ টাকা, ট্রপোনিন-আই ৫০০ টাকা নেয়া হয়। যা বাইরের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ৫/৬ গুণ বেশি। ওসমানিতে বর্তমানে ২টি ক্যাথল্যাব রয়েছে। একটি পুরাতন। গত ২১ সেপ্টেম্বর নতুন ক্যাথল্যাবটি উদ্বোধন হয়।

ওসমানী হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট হাসপাতাল গুলোতে প্রায় ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি ব্যয় হয় রোগ নির্ণয়ের এসব পরীক্ষা সমূহে। তবে ওসমানীতে ১৫ তলা ভবনের কাজ চলছে। ৪৬০ শয্যা বিশিষ্ট ভবনে ক্যান্সার কিডনি, ও হৃদরোগীরা চিকিৎসা নিতে পারবেন। শুধু হৃদরোগীদের জন্য ১০০ শয্যা বরাদ্দ রাখা হবে। এছাড়াও ডায়ালাইসিস ব্যবস্থা থাকবে।


আর পুরো ওসমানীতে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার রোগী সেবা নিয়ে থাকেন আউটডোরে। ৯০০ শয্যার হাসাপাতাল হলেও প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ২৮০০ জন। যেখানে মাত্র ৫০০ শয্যার জনবল রয়েছে। যার মধ্যে ২৫ ভাগ শূণ্যপদ। এছাড়াও অসুস্থতা ও অন্যান্য কারনে অনেকেই ছুটিতে থাকেন। সব মিলিয়ে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে এই অসীম অভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে।


২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সময়ে ইনডোর ও আউটডোরে প্রায় ৩৩ হাজার রোগী রোগ নির্ণয় সেবা গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে সেবা নিতে আসা রোগীরা ইসিজি পরীক্ষা করান ২১ হাজার ২৫৮ জন, ইকো পরীক্ষা করান ১১ হাজার ৩২৯ জন (বিনামূল্যে সেবা নেন- ৪৫১ জন), ইটিটি পরীক্ষা করান মোট ২৬০ জন ( বিনামূল্যে সেবা নেন-১৮ জন), হল্টার করান মোট ৬৪ জন (বিনামূল্যে সেবা নেন-৪ জন)।