মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পরিচিত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা শেখ হাসান নাসরাল্লাহ। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন এই আশঙ্কায় বছরের পর বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন তিনি। তবে শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বৈরুতে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হিজবুল্লাহও। কে ছিলেন হিজবুল্লাহর এই নেতা যাকে হত্যা করতে মরিয়া ছিল ইসরায়েল? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনের আলোকে তাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল নাসরাল্লাহর। হিজবুল্লাহর আজকের এই রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বছরের পর বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও নাসরাল্লাহর প্রতি তার সমর্থকদের শ্রদ্ধা–ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি।
নাসরাল্লাহর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধাসহ ইরাক ও ইয়েমেনের সশস্ত্র যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে গোষ্ঠীটির।
দখলকৃত লেবাননি ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে প্রথমে একটি মিলিশিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে নাসরা্ল্লাহর নেতৃত্বে লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল গোষ্ঠীটি। এছাড়া, লেবাননের জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, শিক্ষাসহ নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত ছিল এটি।
১৯৬০ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকার সাধারণ একজন মুদি ব্যবসায়ী আব্দুল করিমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন হাসান নাসরুল্লাহ। সেখানেই বেড়ে উঠেন। নয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় নাসরাল্লাহ কৈশোরকাল লেবাননের গৃহযুদ্ধের ছায়ায় অতিবাহিত করেন।
১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল আন্দোলনে’ যোগ দেন। এর পর কিছুকাল ইরাকের নাজাফে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটানোর পর লেবাননে ফিরে আবারও আমালে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র যোদ্ধাদের আক্রমণের জবাবে ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ করলে তখন আরও কয়েকজনের সঙ্গে দলটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
১৯৮৫ সালে একটি ‘খোলা চিঠি’ মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে হিজবুল্লাহ। ওই চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইসলামের প্রধান দুই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি মুসলিমদের ভূখণ্ড দখলকারী হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে ধ্বংসের ডাকও দেয় গোষ্ঠীটি।
ইসরায়েলি হেলিকপ্টার হামলায় তার পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাভি নিহত হওয়ার পর ১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরাল্লাহ। দায়িত্ব নিয়েই পূর্বসুরী মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। সে অনুযায়ী তার নির্দেশে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার হয়। ওই হামলায় একটি মেয়ে নিহত হন। তুরস্কে ইসরায়েলি দূতাবাসের একটি গাড়িতে বোমা হামলায় একজন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন এবং আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন আরও ২৯ জন।
লেবাননের সাথে ইসরায়েলের নানা সংঘর্ষের মধ্যেই ২০০০ সালে লেবানন থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। এটিকে নাসরুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথমবারের মতো বিজয়ের দাবি করেন। তখন তার বড় ছেলে হাদি ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালে আবারও ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই বছর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালালে আট ইসরায়েলি সেনা নিহত হন এবং আরও দুজনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় গোষ্ঠীটি।
হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে প্রায় ৪ হাজার রকেট নিক্ষেপ করার পর, লেবাননের দক্ষিণে এবং বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলিতে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। টানা ৩৪দিনের সংঘর্ষে ১ হাজার ১২৫ জনেরও বেশি লেবানিজ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক। একই সময়ে ১১৯ ইসরায়েলি সেনা এবং ৪৫ জন বেসামরিক নিহত হয়েছেন।
নাসরাল্লাহর বাড়ি ও তার অফিসেও হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। তবে ওই যাত্রায় তিনি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান।
২০০৯ সালে নাসরাল্লাহ একটি নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার জারি করে হিজবুল্লাহর ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এটিতে ১৯৮৫ সালের নথিতে পাওয়া একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের উল্লেখ বাদ দেওয়া হয়েছিল। তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছিল এবং পুনর্ব্যক্ত করেছিল, জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে দক্ষিণ লেবাননে তাদের নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহকে তাদের অস্ত্র রাখতে হবে।